আল্লাহর সাথে শিরক করা কী এবং এর শাস্তি

আল্লাহর সাথে শিরক করা কী এবং এর শাস্তি


সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহ হলো আল্লাহর সাথে শরীক স্থির করা। এই শিরক দুই প্রকার। প্রথমত আল্লাহ্ তা'আলার সমকক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী সাব্যস্ত করা এবং তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কোনকিছুর ইবাদত করা যেমন- পাথর পূজা, বৃক্ষ পূজা, সূর্য-চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র, নবী, রাসূল, জ্বিন, ফেরেশতা, দেব-দেবীর পূজা কিংবা কোন পুরোহিতকে অর্ঘ্য দেওয়া ইত্যাদি। এই সব কিছুর আনুগত্য ও ইবাদত করা হলো সর্বাপেক্ষা বড় শিরক। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ জাল্লাশানুহ কুরআন মজীদে ইরশাদ করেন:


إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرِكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ


"আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর সাথে শরীক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। তা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন।" (নিসা: ৪৮)


অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে : إِنَّ الشَّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ


"নিশ্চয়ই শিরক করা চরম জুলুম।" (লুকমান: ১৩)


আরও ইরশাদ হচ্ছেঃ


وَ إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ.


কেউ আল্লাহর সাথে শরীক স্থির করলে আল্লাহ্ তার জন্য জান্নাত হারাম করে


দেবেন এবং তার আবাস জাহান্নাম। (সূরা মায়িদা: ৭২)


শিরক সম্পর্কিত আরও অনেক আয়াত রয়েছে।


যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক স্থির করলো এবং মুশরিক অবস্থায় ইনতিকাল করলো সে ব্যক্তি অকাট্যভাবে জাহান্নামী। যেমন কোন ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলো এবং ঈমানদার অবস্থায় ইনতিকাল করলো সে ব্যক্তি জান্নাতী যদিও গুনাহের কারণে তাকে কিছুকাল জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হয়।


সহীহ হাদীসে হযরত রসূলে করীম (সা) ইরশাদ করেন:


الا انبئكم بأكبر الكبائر .....ليته سكت. 


তিনি বলেন, আমি কি তোমাদের সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহের কথা বাতলে দেব না? তিনি তিনবার কথাটি পুনরুক্তি করলেন। সাহাবায়ে কিরাম (রা) আরয করলেন, জ্বি হ্যাঁ, অবশ্যই বাতলে দেবেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্। তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, সে সময় তিনি হেলান দেওয়া থেকে সোজা হয়ে


বসে পড়েন। তারপর তিনি বললেন, সাবধান! মিথ্যা কথা বলা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। এভাবে তিনি একের পর এক বলেই যাচ্ছিলেন এমন কি আমরা বলাবলি করছিলাম, যদি তিনি থেমে যেতেন। (বুখারী ও মুসলিম)


অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন, "তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক বস্তু হতে বেঁচে থাকো। এরপর তিনি আল্লাহর সাথে শরীক করার বিষয়টি উল্লেখ করেন।"


তিনি আরও বলেন, "যে ব্যক্তি দীন পরিবর্তন করে অর্থাৎ মুরতাদ হয়ে যাবে তোমরা তাকে কতল করো।" (বুখারী ও আহমদ)


দ্বিতীয় প্রকার শিরক হলো রিয়া বা প্রদর্শনীমূলক আমল করা। যেমন আল্লাহ্ তা'আলা ইরশাদ করেন:


فَمَنْ كَانَ يَرْجُوا لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلاً صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا 

সুতরাং যে তার প্রতিপালকের দীদার কামনা করে সে যেন নেক আমল করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করে।" (সূরা কাহফঃ ১১০)


অর্থাৎ কেউ যেন তার কথা ও কর্মের দ্বারা অন্য কিছুকে আল্লাহর সমকক্ষ স্থির না করে। রসূলে করীম (সা) বলেছেন, তোমরা ছোট ছোট শিরক হতে সাবধান থেকো। সাহাবায়ে কিরাম (রা) আরো বললেন, ছোট ছোট শিরক কি ইয়া রাসূলাল্লাহ্! তিনি বললেন, রিয়া অর্থাৎ লোক দেখানো ইবাদত।


আল্লাহ্ তা'আলা কিয়ামত দিবসে বান্দাদের আমলের প্রতিদান সম্পর্কে বলবেন, যাও তোমরা তাদের কাছে তোমাদের কর্মফল লাভের জন্য যাদের দেখানোর উদ্দেশ্যে দুনিয়াতে আমল করেছিলে। এখন পরখ করে দেখ তাদের কাছে তোমাদের জন্য কি প্রতিদান মজুদ আছে? (আহমদ ও বায়হাকী)


রসূলে আকরাম (সা) আরও বলেছেন: হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ্ তা'আলা বলেন, যে ব্যক্তি এমন আমল করলো যাতে সে আমি ছাড়া অন্য কাউকে শরীক করে বসলো সে ব্যক্তি প্রকৃতই মুশরিক এবং আমি তার দায়িত্ব থেকে মুক্ত। (মুসলিম ও ইবনে মাজাহ্)


তিনি আরও বলেন, যে ব্যক্তি অন্তরের কান দিয়ে আমলের নিয়তে শুনে, আল্লাহ্ তা'আলাও তার দোআ কবুল করেন এবং যে ব্যক্তি রিয়া করে আল্লাহ্ তা'আলা তার সাথে অনুরূপ আচরণ করবেন। (বুখারী ও মুসলিম)


হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সা) বলেছেনঃ অনেক রোযাদার এমন আছে যারা তাদের রোযা দ্বারা অনাহারের কষ্ট ও তৃষ্ণা ব্যতীত কিছুই লাভ করে না, আর এমন অনেক রাত জাগরণকারী আছে যারা অনিদ্রা ব্যতীত কিছুই হাসিল করতে পারে না অর্থাৎ তাদের নামায ও রোযা খালেস আল্লাহ্ তা'আলার, রেযামন্দির জন্য না হলে তাতে কোন সওয়াব নেই। (ইবনে মাজাহ ও আহমদ)


নবী করীম (সা) আরও বলেন, যে ব্যক্তি রিয়া-লোক দেখানো ও যশ-খ্যাতির জন্য আমল করে তার উপমা সেই ব্যক্তির মত যে পাথর কণা দ্বারা থলে পরিপূর্ণ করলো। অতপর তা দিয়ে জিনিসপত্র খরিদ করার জন্য বাজারে প্রবেশ করলো। যখন সে তার থলে বিক্রেতার সামনে খুললো তখন দেখা গেল পাথর আর পাথর এবং সে তখন তা তার চেহারার উপর ছুঁড়ে মারল। তার ঐ থলে তার কোন উপকারে এল না। শুধু মানুষের কথা শুনতে হলো। তার থলে ভর্তি হলো না এবং সে তাতে কিছু দিতে পারলো না। এই হচ্ছে সেই ব্যক্তির কার্যকলাপের উদাহরণ যে অন্তসার শূন্য ও যশ-খ্যাতির জন্য আমল করেছে তার জন্য লোকের নানান কথা ব্যতীত কিছুই নেই এবং আখিরাতে তার জন্য কোন সওয়াব থাকবে না।


আল্লাহ্ তা'আলা বলেন:


وَقَدِمْنَا إِلى مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلِ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْشُورًا.


অর্থাৎ আল্লাহ্ তা'আলার সন্তুষ্টি ব্যতিরেকে অন্য কোন উদ্দেশ্যে তারা যে সব আমল করেছে আমি তার সওয়াব বাতিল করে দিয়েছি এবং সেগুলোকে আমি উড়ন্ত ধুলোবালিতে রূপান্তরিত করেছি। যা সে সূর্য-কিরণের মাঝে উড়তে দেখতে পায়।


হযরত আদী ইবনে হাতিম তাঈ (রা) রসূলুল্লাহ্ (সা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন: সাতটি ধ্বংসাত্মক অপরাধ থেকে বিরত থাকো। সাহাবীগণ বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেগুলো কি কি? তিনি বলেন: (১) আল্লাহর সাথে শরীক স্থির করা, (২) যাদুচর্চা, (৩) অন্যায়ভাবে নরহত্যা, যা আল্লাহ হারাম করেছেন, (৪) ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ, (৫) সুদ খাওয়া, (৬) যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন এবং (৭) সতী-সাধ্বী ঈমানদার মহিলার প্রতি যেনার মিথ্যা অপবাদ আরোপ। (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ)


এক ব্যক্তি মহানবী (সা)-কে জিজ্ঞেস করলো, কোন্ পাপ সর্বাধিক মারাত্মক? আল্লাহর সাথে কাউকে তোমার শরীক স্থির করা অথচ তিনি তোমায় সৃষ্টি করেছেন। সে বললো, তারপর কোনটি? তিনি বলেন, তোমার খাদ্যে অংশগ্রহণের আশংকায় তোমার সন্তান হত্যা করা। সে বললো, তারপর কোনটি? তিনি বলেন, তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে তোমার যেনায় লিপ্ত হওয়া। এর সমর্থনে আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেনঃ "যারা আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহকে ডাকে না। (শিক্ক করে না), যে প্রাণহত্যা আল্লাহ হারাম করেছেন, তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে না এবং যেনা করে না।” (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ)

Post a Comment

0 Comments